বরফ তুলোর দেশে...
বরফ তুলোর দেশে...
✍ তন্ময় শান্ডিল্যদেব তালুকদার
(১)
আজ ভীষণ তুষারপাত হচ্ছে। সাদা তুলোর ন্যায় বরফ এসে পড়ছে চারপাশে। নিউইয়র্কের রাস্তাঘাট তুষারে ঢেকে যাচ্ছে। এখানে সবাই যদিও বলে Snow Fall, কিন্তু আবির বলে বরফ তুলোর উপত্যকা। আহঃ, শুনতেও লাগে ভারী মিষ্টি।
- নিউ ইয়র্ক তাহলে সু প্রাচীন ইট পাথরে ঢাকা ঐতিহাসিক একটি বরফ তুলোর উপত্যকা! বাঃ।
- না নিউইয়র্ক নয়। বরফ তুলোর উপত্যকার মতোই লাগে খানিকটা। কিন্তু এটা নিউ ইয়র্ক নয়। বরফ তুলোর উপত্যকা ভারতে। হিমালয়ে।
- এবার চলো আসার আগে তাহলে হিমালয় ঘুরে আসি। সিমলা, মানালী, লাদাখ, কাশ্মীর বা বা উত্তরকাশী... কেমন হবে বলো?
- উত্তরকাশী! আহঃ, বরফ তুলোর উপত্যকা।
- উত্তরকাশীকে বরফ তুলোর উপত্যকা বলো তুমি?
- উত্তরকাশীও বলতে পারো।
- কখনো গিয়েছো?
- নাঃ। তবে মহালয়াও যায় নি।
- মহালয়া! কে সে?
- যার জন্যে বরফের তুলোরা উপত্যকা রচনা করেছিলো!
(২)
তুষার পাত শেষ হয়েছে গতকাল। এখনও এখানে সেখানে তুষার। যেন আবিরের বরফ তুলোর উপত্যকা। আজ ফ্লাইট দেশের। প্রায় সাত বছর পর দেশে যাচ্ছে আবির।
- প্রথমে কোথায় যাচ্ছো? কোলকাতা নাকি...
- প্রথমেই উত্তরকাশী। বরফ তুলোর উপত্যকায়।
- পাগল একটা! এসে মহালয়ার গল্প শুনাবে কিন্তু!
আবিরের ফ্লাইট ঠিক সন্ধ্যে সাতটায়। জেএফকে থেকে রওনা হলো। উড়াল দিলো পুবের আকাশে।
ভোর হতেই জানালায় সারি সারি মেঘ তুলোর মতো ভেসে আছে। মেঘের সমুদ্র যেন। আবির ফোনের ডায়েরীতে লিখতে থাকলো এ যেন বরফ তুলোর উপত্যকা।
একটি মিথ্যে নিয়ে মহালয়ার সাথে পরিচয় আবিরের। কখনোও ভাবতেই পারে নি কেউ একজন এভাবে জীবনকে নতুন করে অর্থবহ করে দিতে পারে অন্যরকম ভাবে। নাহলে আবির তো টেকনোলজি দুনিয়ার ছেলে। থাকতো পরে দিন রাত নিজের কম্পিউটার সায়েন্স নিয়েই। হঠাৎ শহরের উপকণ্ঠের একটি মেয়ে যে কিনা সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের, থাকতো পরে আর্টস নিয়ে আর শিল্পকলার আশেপাশের জগতে, এসে নাড়িয়ে দিলো আবিরকে। টেকনোলজির হৃদয়ে একটি অনুভূতির বৃক্ষ রোপিত হয়ে গেলো!
কিন্তু মিথ্যে দিয়ে যা শুরু তা মিথ্যেই হয়ে যায়। মিথ্যেটা ঘিরেই পথচলা। আর মিথ্যেতে জড়িয়েই হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু হৃদয় থেকে মহালয়ার সুর মুছে গিয়েছে কি? আবিরের সাথে আজ ১০ বছর ধরে কোনও যোগাযোগ নেই মহালয়ার। সাত বছর হয়ে গেলো আবির দেশেও নেই। এই ভিন দেশে এসেও আজও প্রায় সকালেই আবিরের ঘুম ভাঙ্গে মহালয়ার ওঠোওওওওও শুনে, হ্যাঁ দশ বছর ধরে সত্যি সত্যিই শুনে নি হয়তো, কিন্তু অনুভব করেছে হৃদয়ের গভীরে। অনুভব করেছে কারও বাচনভঙ্গির প্রতিটা স্বকীয়তাকে।
আজও তাই আবিরের মন ছুটে চলে মনেরও নিজ নিকেতনে, মহালয়ার মহা আবেশে। বরফ তুলোর উপত্যকা আসলে তাদের দুজনেরই স্বপ্নের ভ্রমণ। মহালয়া প্রায়ই লাদাখ আর কাশ্মীরের সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতো, প্রায় দিনই অভিভুত রইত উত্তরকাশীর বরফ তুলোর উপত্যকায়। আজও আবিরের মনে হয় এই তিনটি শব্দেও যেন মহালয়ার স্পর্শ পাওয়া যায়। আবির তাই ঠিক করেছে উত্তরকাশী গিয়ে মন প্রাণ দিয়ে এক বুক হাওয়া নিয়ে অনুভব করবে শুধুই মহালয়াকে।
(৩)
প্লেন যখন নামলো দিল্লীতে। তখনও সন্ধ্যে। রাতেই রওনা হলো আবির। চারদিকে বরফে ঢাকা এই সুন্দর উপত্যকাগুলো দেখলে মনে হয় সত্যিই এই তো বরফ তুলোর উপত্যকা।
উত্তর কাশী থেকে খানিক দূরেই সঙ্গমছাট্টি। সিদ্ধিদাতা ভগবান গণেশের জন্মস্থান। অনেকেই ওখানে নিজের প্রিয় চাওয়া পাওয়া বা প্রিয় কিছু লিখে প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে বেলুন উড়াচ্ছে।
আবির গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেলো বেলুন উড়াতে।
কয়েকজন পাহাড়ী রঙ বেরঙের বেলুন বিক্রি করছে। লিখে দিচ্ছে যার যা লিখার। আবির দেখলো প্রায় সব কটাতেই জটলা। একজনের এখানে শুধু পাঁচ ছ জনের জটলা। সেখানেই গেলো। একটি বেলুন চাইলো সাদা রঙের।
- কি লিখবো বাবু?
পাশে থেকে ঝিন ঝিন কন্ঠে কে যেন বলে উঠলো,
- বরফ তুলোর উপত্যকা।
একটি ছোট্ট মেয়ে। সেও বেলুন নিচ্ছে। কিন্তু এই শব্দবন্ধ! কোথায় পেলো সে?
- এই মামণি, তুমি এটা লিখাচ্ছো কেন বলো তো?
- মা বলেছে তাই।
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো আবির আবারও,
- তোমার নাম কি গো মা?
- মহালয়া। বলেই দৌড়ে গেলো বেলুন হাতে। ওদিকে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। একটি দম্পতিকে দেখা যাচ্ছে হাসতে হাসতে মেয়েকে কোলে তুলে নিতে।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, মহালয়াকে আবিরই মহালয়া নামে ডাকতো। ওর আসল নাম মহালয়া ছিলো না।
ওদের ডেকে আবির স্মিত হেসে ছোট্ট মহালয়াকে বেলুনটি দিলো।
- হ্যালো মহালয়া, এটাও তোমার জন্য।
- থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কেল। বলেই খিক করে হেসে উঠলো।
ভদ্রতার স্মিত হাসি দম্পতিটিরও মুখে লেগে আছে।
না, খুঁচা খুঁচা দাঁড়ি, সানগ্লাস আর দশ বছরের দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে আসা স্যুট টাইয়ের আবিরকে চিনতে পারে নি ছোট্ট মহালয়ার মা।
পরের দিনের ফ্লাইটে আবির আবার নিউ ইয়র্কে। মহালয়ার স্মৃতি নিউ ইয়র্কেই ভালো রোমন্থন করা যায় তুষার ছন্দের আবেশে। ভারতে বরফ তুলোর উপত্যকা কেন জানি বেমানান মনে হচ্ছে।
শত কিছু হোক, অনুভবে বাস্তব কখনওই স্বপ্নের ন্যায় সত্যি কিছু হয় না।
#মহালয়া_সিরিজ
Comments
Post a Comment